কোন কোন শাকসব্জি ডায়াবেটিসে উপকারী | ডায়াবেটিসের শাকসব্জি

কোন কোন শাক ও সব্জি ডায়াবেটিস উপকারী

ডায়াবেটিসের শাকসব্জি

হাই ফাইবার, লো-ক্যালোরি, প্রোটিন ও‌ অন্যান্য নিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ সব্জি হল স্বাস্থ্যকর ডায়াবেটিস ডায়েট। শাকসব্জিতে উপস্থিত ডায়েটিক ফাইবার রক্তের সুগার লেবেল, কোলেস্টেরল ও ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। এছাড়া পেট দীর্ঘক্ষন ভর্তি থাকে, খিদে কমাতে সাহায্য করে। ফলে সুগার আমাদের অন্ত্রে ধীরে ধীরে শোষিত হয়ে রক্তে ব্যালেন্স অবস্থায় থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের সব সময় কম শ্বেতসার জাতীয় সব্জি গ্রহণ করা উচিত।

শাকসব্জিকে সাধারণত দু'ভাগে ভাগ করা যায়- 

  • ১) শ্বেতসার সমৃদ্ধ 
  • ২) কম শ্বেতসার যুক্ত।

বেশি শ্বেতসার সমৃদ্ধ শাকসব্জি

এই ধরনের শাক সব্জিতে কার্বোহাইড্রেট -এর পরিমাণ বেশি থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে তোলে। তাই এদের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) বেশি থাকে।

কম শ্বেতসার যুক্ত শাকসব্জি

এই ধরনের শাক সব্জিতে শ্বেতসারের পরিমাণ কম থাকে, তাই এদের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) কম হয়, যা ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে খুব ভালো। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পাঁচমেশালী স্যালাড খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। এতে টমেটো, লেটুস শাক, পেঁয়াজ, মটরশুটি, গাজর, শসা, মুলো ও ধনেপাতা ইত্যাদির মিশ্রণ রাখলে খুব ভালো হয়। এদের পুষ্টিকর উপাদানগুলির ভূমিকাও অতুলনীয়। 

মাটির নিচের সব্জি অর্থাৎ মূল ও কন্দ জাতীয় সব্জি খুবই কম পরিমাণে খাওয়া উচিত। কারণ এই সমস্ত সব্জিতে শর্করা ও শ্বেতসারের পরিমাণ বেশী থাকে, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। 

কন্দ জাতীয় সব্জির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৪০-৯০ -এর মধ্যে থাকে। যেমন, বিটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬৫, আলুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬০-৯০। তাই এই ধরনের সব্জি ডায়াবেটিস রোগীদের দৈনন্দিন জীবনের খাবারে না রাখা বা কম রাখা ভালো। এমনকি এই ধরনের সব্জি রান্না করে খেলে এর শর্করার মাত্রা আরও বেড়ে যায়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। 

পাতা জাতীয় শাকসব্জি যেমন, পালং শাক, বাঁধাকপি, লেটুশ ইত্যাদিতে কম পরিমাণে শ্বেতসার ও অধিক পরিমাণ ফাইবার থাকার জন্য ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে ভালো। 

লেগুম জাতীয় সব্জি যেমন বাদাম, বিনস, মটর, ছোলা ইত্যাদির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ২৫-৫০ -এর মধ্যে থাকে। এদের মধ্যে এক ধরনের শ্বেতসার থাকে, যা ধীরে ধীরে হজম হয় এবং রক্তে শর্করার লেবেল ব্যালেন্স রাখে।

কিছু কম শ্বেতসার যুক্ত শাকসব্জি যেমন- টমেটো, সজনে শাক, সজনে ডাঁটা, লেটুস শাক, ব্রকোলি, পালং শাক, বাঁধাকপি, কর্ন, বিনস, বরবটি, মেথি শাক, ফুলকপি, ক্যাপসিকাম, শসা, করলা, কাঁচকলা, উচ্ছে, মাশরুম, ও মটর ইত্যাদি যেমন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তার পাশাপাশি শরীরের ওজনও নিয়ন্ত্রণ করে।

ডায়াবেটিসে খাবেন কোন শাকসব্জি 

পালং শাক

স্বাস্থ্যকর শাক সব্জির মধ্যে পালং শাকের স্থান শীর্ষস্থানে। তবে পালংশাক যত তাজা হবে তার গুণগতমানও বেশি হবে। পালংশাক অত্যাধিক পুষ্টিকর এবং ক্যান্সার প্রতিরোধক। শাকটিতে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন রয়েছে, যা ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে খুবই উপকারী‌। শীতকালের পালং শাকের উপকারিতা অনেক বেশি। সারাবছর যেসব পালং বাজারে আসে, তা হিমঘর থেকে আসে সেগুলি না খাওয়াই ভালো। 

নিমপাতা

আজকাল আমরা বিভিন্ন ঋতুতে গজানো একদম কচি নিমপাতাকেও সুব্জি হিসেবে খেয়ে থাকি। এটি সুগার নিয়ন্ত্রণ করে, ইনসুলিনের সেনসিটিভিটি বাড়ায়। শিরা উপশিরায় রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন সকালে ২-৩ টি নিমপাতা খালি পেটে চিবিয়ে খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, ও অনেকটা কমে। 

বিনস

এতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন ও ফাইবার থাকায় ডায়াবেটিস রোগে খুবই উপকারী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন এক কাপ বিনস খেলে ব্লাড সুগার ও প্রেশার সমতায় থাকে।

বাঁধাকপি

এতে আছে সালফরাপেন যা ক্যান্সার প্রতিরোধক। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই কার্যকরী। এটি ওজন কমায়, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে ও ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়ায়। জয়েন্ট পেন, অ্যালার্জি, ব্লাড প্রেশারে ভালো কাজ দেয়। এতে রয়েছে ভিটামিন K যা ব্রেন ভালো রাখে। বাঁধাকপি মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতিবিভ্রম আটকায়। বাঁধাকপিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম যা হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। 

ব্রকোলি ও ফুলকপি

ফুলকপি ও বাঁধাকপির সঙ্গে একই পরিবারের সদস্য ব্রকোলি। এটি বিভিন্ন ভিটামিনে পরিপূর্ণ। এই সমস্ত সব্জি প্রচুর পরিমাণে উপকারী ফাইবার ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। যা সুগার রোগীর হার্ট, কিডনি ও নার্ভের পক্ষে উপকারী।

হলুদ

এর অধিক ব্যবহার রান্নাঘরে হলেও, রান্নাঘরের বাইরেও হলুদ এর অবদান অতুলনীয়। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত অঙ্গের জন্য হলুদ খুবই উপকারী। হলুদ একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ঘরোয়া মশলা। এটি হার্ট সুস্থ রাখে, ব্লাডসুগার ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হলুদে উপস্থিত কারকুমিন ডায়াবেটিস রুখতে সাহায্য করে। এছাড়াও হলুদ

ডায়াবেটিস রোগীদের ত্বক ও কিডনি সংক্রান্ত সমস্যায় ভালো কাজ দেয়। 

আদা

আদা একটি সহজলভ্য জিনিস, বাড়ির রান্নার কাজে এটি বহুল ব্যবহৃত হয়। খুব সহজেই এটি আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাই। আদা রক্তের শর্করা ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইনসুলিন সেনসিটিভিটি উন্নত করে। এছাড়া ওজন কমাতেও সাহায্য করে। সামান্য গরম ভাতে হালকা করে আদা-রসুন ভাজা খেলে ডায়াবেটিস রোগীরা উপকার পাবেন।

ফ্ল্যাক্স সিড

এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এক ধরনের লিগনাল উপাদান থাকে, যা সুগার লেবেল নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়াও খারাপ কোলেস্টেরল কমায়, হার্টকে সুস্থ রাখে। 

কারিপাতা

বিভিন্ন তরিতরকারি এবং সুস্বাদু খাবারে এক অনন্য স্বাদ আনতে কারিপাতা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তা বাদেও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে কারি পাতা ব্যবহৃত হয়। কারিপাতা ডায়াবেটিস রুখতে ও বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কারিপাতা তে এমন এক ধরনের উপাদান আছে যা শ্বেতসারকে শর্করা তৈরি করতে বাধা দেয়। এটি কোলেস্টরল কমাতেও সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে খালিপেটে চিবিয়ে খেলে উপকার দেয়।

রসুন

এটি ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হার্টকে সুস্থ রাখে। এটি রক্তনালীর কাঠিন্য ভাব কমিয়ে হার্টের রোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে। উপস্থিত সালফার কম্পাউন্ড ডায়াবেটিকদের অক্সিডেটিভ ডেমেজ রুখতে সাহায্য করে

লাল পেঁয়াজ

এতে এক ধরনের অদ্রবণীয় ফাইবার থাকে, যা ক্ষুধা  কমিয়ে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

ফুলকপি

এতে সালফোরাফেন থাকে, যা গ্লুকোজ তৈরিতে বাধাপ্রদান করে। এছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবারও থাকে।

টমেটো

বিভিন্ন ধরনের চাটনি থেকে শুরু করে, ডাল, চচ্চড়িতেও আমরা টমেটো ব্যবহার করে থাকি। আমরা সাধারণত এর গুনাগুন না জেনেই এই সব্জি খেয়ে থাকি। কিন্তু এই সব্জির গুণাগুণ অনেক। টমেটো কাঁচা অবস্থায় স্যালাড বা স্ন্যাক্স হিসেবেও খাওয়া যায়। এতে খুবই কম পরিমাণ ক্যালোরি এবং উন্নত মানের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট লাইকোপিন, ক্যারাটনিয়েড থাকার জন্য খুবই উপকারী।

গাজর

এতে উন্নত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিটাক্যারোটিন ও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়াম, ও ফাইবার থাকায় এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের চোখের পক্ষে খুব ভালো। গবেষণায় জানা গেছে, বিটাক্যারোটিন সমৃদ্ধ সব্জি টাইপ-২ ডায়াবেটিসে খুবই উপকারী।

ডায়াবেটিসের শাকসব্জি

সয়াবিন

সয়াবিনে অধিক পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন B, জিঙ্ক, ফোলেট ও আলফা লিনোলেনিক এসিড থাকায় উপকারী। এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল খুবই কম পরিমাণে থাকে।

ওট

এতে এক ধরনের ফাইবার ও বিটা গ্লুকোজ থাকে, যা রক্তে শর্করা ও ব্লাড প্রেশার কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এতে উপস্থিত ফাইবার পাকস্থলীকে ভরা রেখে খিদে কমাতে সাহায্য করে।

ক্যাপসিকাম

ক্যাপসিকাম আমরা বাজারে কিংবা বাড়িতে বিভিন্ন রঙের পেয়ে থাকি যেমন- সবুজ, লাল, হলুদ ও কমলা বর্ণের হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন C, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, বিটাক্যারোটিন, লাইকোপিন থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে খুবই উপকারী।

করলা

করলা একটি তেতো সব্জি, তাই এটি ডায়াবেটিসে খুবই উপকারী। প্রতিদিন সকালে ১ কাপ করলার রস খেলে সুফল মেলে। প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন ক্ষরণ বৃদ্ধি করে ও ইনসুলিন রেজিট্যান্স দূর করে। 

সজনে শাক

সজনে শাক একটি সুস্বাদু শাক। এটি  গ্রামের প্রায় সবার বাড়িতেই হয়ে থাকে। সজনে শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A, B, C, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বিভিন্ন তরিতরকারি হিসেবে সজনে পাতা খেয়ে থাকি। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে ১ কাপ সজনে পাতার রস খালি পেটে নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের ভালো কাজ দেয়।

মেথিশাক

মেথিশাক ও বীজ খুবই উপকারী। ১ চামচ মেথি বীজ সারারাত জলে ভিজিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে চিবিয়ে খেলে মধুমেহ রোগে ভালো কাজ দেয়। মেথিশাক ও বীজ ইনসুলিন ক্ষরণে সাহায্য করে। অধিক পরিমাণে ফাইবার থাকায় অন্ত্রে সুগার শোষণে বাধা দেয়। এছাড়া খারাপ কলেস্টেরল কমাতেও সাহায্য করে।

এছাড়া আরো অনেক ধরনের শাকসব্জি আছে যেগুলি আমরা খুব সহজেই হাতের কাছে পেয়ে থাকি যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।

ডায়াবেটিসের শাকসব্জি
Kolkata Corner


 

Post a Comment

0 Comments