জ্ঞানবাপী মসজিদ | ভারতে মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির

জ্ঞানবাপী মসজিদ

তথ্য ও ইতিহাস: জ্ঞানবাপী মসজিদ, যেটিকে কখনো কখনো আলমগীর মসজিদও বলা হয়ে থাকে। বারানসি তে অবস্থিত এই জ্ঞানবাপী মসজিদ, কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একদম লাগোয়া। তথ্য অনুযায়ী, মোগল সাম্রাজ্যের শাসক ঔরঙ্গজেব প্রাচীন বিশ্বেশ্বর মন্দির ভেঙে এই জ্ঞানবাপী মসজিদ বানিয়ে ছিলেন। জ্ঞানবাপী একটা সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ হল জ্ঞানের কুঁয়ো। এখানে বলে রাখা ভালো, বর্তমানে খবরের শিরোনামে উঠে আসা এই জ্ঞানবাপী মসজিদ সম্পর্কিত বিতর্ক সম্প্রতিক নয়। তথ্যানুসারে, ১৯৫১ সাল থেকে এই মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরীর আইনি লড়াই চলছে। এবং বর্তমানে অর্থাৎ 2022 সালে সমীক্ষার পর এই বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। 

জ্ঞানবাপী মসজিদ ইতিহাস

কাশী বিশ্বনাথ মন্দির লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদ কে বানিয়েছিল, এই নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন চলছে। এই বিষয় সম্পর্কিত কোনো প্রত্যক্ষ ও শক্তপোক্ত ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কিন্তু এটা মনা হয়, যে মোগল শাসক ঔরঙ্গজেব কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙেই জ্ঞানবাপী মসজিদ স্থাপন করেন।

অবস্থান জ্ঞানবাপী মসজিদটি ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে অবস্থিত। এটি একটি পুরানো শিব মন্দির ভেঙে 1669 সালে ঔরঙ্গজেব দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির থেকে 1 মিনিটের হাঁটা
ঠিকানা 31-24, জ্ঞানবাপী মেইন রোড, লাহোরি টোলা, জ্ঞানবাপি, উত্তর প্রদেশ 221001
প্রতিষ্ঠাতা ঔরঙ্গজেব
মিনারের সংখ্যা 2 টি
স্থাপত্যশৈলী মুঘল স্থাপত্য
গম্বুজ(গুলি) 3 টি

জ্ঞানবাপী মসজিদ মসজিদের ইতিহাস

কথিত আছে কাশীতে একটি বিশাল শিবের মন্দির ছিল। মধ্যযুগীয় সময়ে এটি ভেঙে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। আজকের এই প্রতিবেদনে জানুন কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এবং জ্ঞানভাপি মসজিদের প্রাচীন ইতিহাস। 

হিন্দুপুরাণ অনুসারে, কাশীতে বিশাল মন্দিরে আদিলিঙ্গের আকারে অবিমুক্তেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রাচীনত্ব: বিশ্বনাথ মন্দির, যা খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে রাজা হরিশচন্দ্র দ্বারা সংস্কার করা হয়েছিল, সম্রাট বিক্রমাদিত্য তার আমলে সংস্কার করেছিলেন।

১৪৪৭: মন্দিরটি স্থানীয় জনগণ পুনঃনির্মাণ করেছিলেন কিন্তু জৌনপুরের শার্কি সুলতান মাহমুদ শাহ কর্তৃক ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।  তবে এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

১৫৮৫: রাজা টোডরমলের সহায়তায় পণ্ডিত নারায়ণ ভট্ট এই স্থানে আবার একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন।

১৬৩২: শাহজাহান মন্দিরে আদেশ দেন এবং এটি ভাঙার জন্য সেনা পাঠান। হিন্দুদের প্রবল প্রতিরোধের কারণে সেনাবাহিনী বিশ্বনাথ মন্দিরের কেন্দ্রীয় মন্দির ধ্বংস করতে পারেনি, তবে কাশীর আরও ৬৩ টি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

১৬৬৯: ১৮ ই এপ্রিল ১৬৬৯, ঔরঙ্গজেব কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দেন। কলকাতার এশিয়াটিক লাইব্রেরিতে আজও এই ডিক্রি সংরক্ষিত আছে। এল.পি শর্মার বই 'মধ্যযুগীয় ভারত'-এ এই ধ্বংসের বর্ণনা রয়েছে। সাকি মুস্তায়েদ খান রচিত 'মাসিদে আলমগিরি'-তে এর উল্লেখ রয়েছে।

১৬৬৯: ২ রা সেপ্টেম্বর ১৬৬৯ -এ, ঔরঙ্গজেবকে মন্দির ধ্বংসের সমাপ্তির কথা জানানো হয়েছিল এবং তারপরে জ্ঞানবাপী কমপ্লেক্সে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।

১৭৩৫: মন্দিরটি ভেঙে ফেলার পর ১২৫ বছর ধরে বিশ্বনাথ মন্দির ছিল না। ১৭৮০ সালে হিন্দু মারাঠা রানি অহল্যা বাই হোলকার কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন। নবনির্মিত মন্দিরটি মসজিদের পাশেই নির্মিত হয়। সেই সময় থেকে মন্দির ও মসজিদ দুটি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে। দুইয়ের মাঝে লোহা ও কাঁটাতারের বেড়া আছে। দুইয়ের মাঝে জ্ঞানবাপি নামে কুয়োটিও আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, ঔরঙ্গজেব মন্দির আক্রমণ করলে মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

১৮০৯: জ্ঞানবাপী মসজিদের বিতর্ক প্রথমবারের মতো উত্তপ্ত হয়, যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের কাছে জ্ঞানবাপি মসজিদ হস্তান্তরের দাবি জানায়।

১৮১০: ৩০ শে ডিসেম্বর, ১৮১০ তারিখে, বেনারসের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ওয়াটসন 'ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন কাউন্সিল'-এর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন যাতে তিনি জ্ঞানবাপি কমপ্লেক্স চিরতরে হিন্দুদের কাছে হস্তান্তর করতে বলেছিলেন, কিন্তু তা কখনই সম্ভব হয়নি। 

১৮২৯-৩০: গোয়ালিয়রের রাণী বৈজাবাই এই মন্দিরে জ্ঞানবাপীর একটি মণ্ডপ তৈরি করেন এবং মহারাজা নেপাল সেখানে একটি বিশাল নন্দী মূর্তি স্থাপন করেন।

১৮৮৩-৮৪: জ্ঞানবাপি মসজিদের প্রথম উল্লেখ রাজস্ব নথিতে জামা মসজিদ জ্ঞানবাপী হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।

১৯৩৬: ১৯৩৬ সালে দায়ের করা একটি মামলায় ১৯৩৭ সালের রায়ে জ্ঞানবাপি একটি মসজিদ হিসাবে গৃহীত হয়।

১৯৮৪: কিছু জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সাথে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জ্ঞানবাপী মসজিদের জায়গায় একটি মন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার শুরু করে।

১৯৯১: হিন্দু পক্ষের পক্ষে হরিহর পান্ডে, সোমনাথ ব্যাস এবং অধ্যাপক রামরং শর্মা মসজিদ এবং পুরো কমপ্লেক্সে জরিপ ও উপাসনার জন্য আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেন।

১৯৯১: মসজিদের জরিপের জন্য একটি পিটিশন দাখিল করার পর সংসদ উপাসনার স্থান আইন প্রণয়ন করে। এরপর আদেশ দেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্টের আগে কোনো ধর্মের উপাসনালয় পরিবর্তন করা যাবে না।

রামজন্মভূমি চত্বরের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর হিন্দু করসেবকরা ওই স্থানে হিন্দু মন্দির স্থাপনের দাবি জানায়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ঘটনা ঘটার পর এক হাজার পুলিশ দিয়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও জ্ঞানবাপি মসজিদ ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। মসজিদটি এখনও চালু আছে। এটি ধর্মস্থান (বিশেষ সুবিধা) আইন, ১৯৯১ অনুসারে বিশেষ সুরক্ষা পেয়ে থাকে। 

১৯৯৩: বিরোধের কারণে এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়।

১৯৯৮: আদালত মসজিদের জরিপের অনুমতি দেয়, যা এলাহাবাদ হাইকোর্টে মসজিদ পরিচালনা কমিটি চ্যালেঞ্জ করেছিল। এরপর জরিপের অনুমতি বাতিল করে আদালত।

২০১৮: সর্বোচ্চ আদালত ছয় মাসের জন্য আদেশের বৈধতা জানায়।

২০১৯: বারাণসী আদালতে এই বিষয়ে আবার শুনানি শুরু হয়। 

২০২১: মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত শ্রিংগার গৌরী মন্দিরে পূজা করার অনুমতি চেয়ে কিছু মহিলা আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন এবং একটি সমীক্ষার দাবি করেছিলেন। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট জ্ঞানবাপি মসজিদের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের অনুমোদন দেয়।

২০২২: আদালতের আদেশ অনুসারে, জ্ঞানবাপী মসজিদের জরিপ কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুনানি শুরু হবে।

এরকম বিভিন্ন বিষয়ের আপডেট পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল জয়েন করুন- (Click Here)

Post a Comment

0 Comments