কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) কেন হয় | কোষ্ঠকাঠিন্য হলে কি কি সমস্যা হয়

কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়

কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) কেন হয়

কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) এমন একটি রোগ যা আমাদের প্রতিদিনের ক্রিয়া কলাপে মারাত্মক আঘাত আনতে পারে। আমরা যে খাদ্য গ্রহন করি, তা যদি আমাদের শরীর হজমই না করতে পারে তাহলে আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাব রয়ে যায়, এবং সেখান থেকে জন্ম নেয়ে  বিভিন্ন ধরনের রোগ। আমাদের বিপাকীয় প্রক্রিয়া কে দুর্বল করতে সহায়তা করে থাকে বাজারের খোলা খাবার ও অধিক মশলা জাতীয় খাবার। আবার অনেক সময় ভিন্ন কারণও দেখা দিতে পারে তাই, কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসা খুব প্রয়োজনীয়। । তাই আজ আমরা জানবো যে কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) ব্যাপারে ও সেটি থেকে কি ভাবে আমরা মুক্তিলাভ করতে পারি।

কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়

কোষ্ঠকাঠিন্য কোনও রোগ নয়, রোগের লক্ষণমাত্র। এই সমস্যা হয় মূলত হজমের সমস্যার জন্য। অর্থাৎ যে খাদ্যবস্তু আমরা প্রতিদিন খাই তা ঠিকমতো হজম না হলেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর অম্ল, পেটে বায়ু জামার মতো সমস্যা রয়েছে। দেখা গিয়েছে, এই ধরনের সমস্যা হয় নিয়মিত শাকসব্জি না খাওয়ার অভ্যাস থাকলে।

কোষ্ঠকাঠিন্য কাদের হয়

বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ, মহিলা হোক বা পুরুষ, যে কারও এই সমস্যা হতে পারে। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আজকাল কোষ্ঠকাঠিন্য প্রায়শই দেখা যাচ্ছে। কারণ আর কিছুই নয়, বর্তমানে ছেলে মেয়েরা বাইরে কাজ করে, ঠিক টাইমে খাওয়া দাওয়ার সময় পায়না। অবেলায় লাঞ্চ-ডিনার সারে। এর থেকে হজমের টানা সমস্যা থেকে যায় তাদের। আবার বাড়ির খাবার খাওয়ার সময় না পেয়ে অফিসের ক্যান্টিনে বা হোটেল থেকে খাবার খেয়ে উদরপূর্তি করতে হয় বহু তরুণ-তরুণীকে। বেশিরভাগ হোটেল ও ক্যান্টিনে ভাত-সব্জির বদলে পাওয়া যায় বিরিয়ানি, মাটন, ময়দার পরোটা। এগুলিতে ফাইবারের পরিমাণ থাকে সামান্য, ফ্যাটের পরিমাণ বেশি। খাদ্যে সঠিক পরিমাণে তন্তুজাতীয় উপাদান না থাকলে কোষ্ঠ সাফ হবে না। তাই দিনের পর দিন ধরে এই ধরনের খাদ্য গ্রহণের কারণে ধীরে ধীরে সুস্থ মানুষকেও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আঁকড়ে ধরে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজের চাপে অনেকেই সঠিক পরিমাণে জল পান করেন না। এর অন্যতম ফলাফল হল কোষ্ঠকাঠিন্য।

কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) রোগের কারণ

  • খুব বেশি মাত্রায় চা ও কফি পান
  • ঝাল মসলার খাবার খাওয়া
  • পরিশ্রম না করা
  • রাতজাগা ও অনিদ্রা
  • কম জল খেলে
  • আঁশজাতীয় বা ফাইবার যুক্ত খাবার, শাক-সবজি ও ফলমূল কম খেলে
  • পনির, ছানা ইত্যাদি দুগ্ধজাত খাবার অত্যাধিক পরিমাণে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়াতে পারে
  • কায়িক পরিশ্রম, হাঁটা-চলা বা শরীরচর্চা একেবারেই না করলে
  • দীর্ঘদিন কোনও অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে থাকার ফলে
  • মারাত্মক দুশ্চিন্তা বা অবসাদের ফলে
  • অন্ত্রনালীতে ক্যান্সার হলে
  • ডায়াবেটিস হলে
  • মস্তিষ্কে টিউমার হলে এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ

টয়লেটে ঢুকে দীর্ঘক্ষন কাটানোর পরেও কোষ্ঠ সাফ হয়না। অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে পেট পরিষ্কার করতে হয়। সপ্তাহে তিনবারের বেশি মল ত্যাগ হয় না। শক্ত গুটলির মতো কোষ্ঠনির্গমন হয়, বারবার মলত্যাগ করতে যাওয়ার পরও কোষ্ঠ সাফ না হলে, সেই সমস্যাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলা যায়। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে কোষ্ঠ নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়।

মাথায় সব সময় যন্ত্রণা করা, পেটের মধ্যে অনবরত ভুটভাট করে অম্বল হয় ও পায়খানা পায়খানা ভাব থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার

পেট ভরে খাবেন না। পেটে সামান্য খিদে রেখে খাদ্য গ্রহণ করুন। সারাদিন অল্প অল্প করে খান। এতে পাচনতন্ত্র সুস্থ থাকে, খাদ্য হজমে সাহায্য হয়। খাবার সময় হাতে সময় রাখুন অর্থাৎ তাড়াহুড়োতে না খেয়ে ধীরে ধীরে সময় ধরে খান। খাবার চিবিয়ে খান। আমাদের মুখে অনেকগুলি গ্রন্থি আছে সেখানে নানা লালা মেশে খাবারের সঙ্গে, লালায় থাকে হজমে সহায়ক নানা জিনিস। ফলে জটিল খাদ্য থেকে সরল খাদ্যে রূপান্তরিত হতে সুবিধা হয়। 

বাইরের ফাস্টফুড, অতিরিক্ত তেল দেওয়া খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করুন। চেষ্টা করুন বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর খাবার খেতে। রান্নায় থাকুক সামান্য পরিমাণ তেল, ঝাল মসলা কম দিন। সব্জি খান, সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন। একইসঙ্গে তামাক, গুটকা, খৈনি, ধূমপান, মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এইসব কু-অভ্যাস কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায়ী থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) প্রতিকারের ৬ টি অভ্যাস 

কোষ্ঠকাঠিন্য একটি বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা। অনেকের টয়লেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, কিন্তু পেট পরিষ্কার হয় না। এ নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন তাঁরা। মলত্যাগ যদি সপ্তাহে তিনবারের কম অথবা পরিমাণে খুব কম হয়, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও মলত্যাগ না হয়, অথবা মল অস্বাভাবিক রকমের শক্ত বা শুকনো হয়, তাহলে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। বিভিন্ন কারণে এ সমস্যা দেখা দেয়। তবে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস কোষ্ঠকাঠিন্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। 

তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১. প্রতিদিন প্রচুর পানি ও তরল এবং যথেষ্ট আঁশযুক্ত খাবার খান। গোটা শস্য, শাকসবজি, ফলমূল যেমন বেল, পেঁপে ইত্যাদি হলো আঁশযুক্ত খাবার।

২. পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপনের চেষ্টা করুন।

৩. যত দূর সম্ভব মল চেপে না রাখার অভ্যাস করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটাচলার অভ্যাস গড়ে তোলা।

৪. ইসবগুলের ভুসি, অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর মতো ঘরোয়া টোটকাও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমাধানে বেশ কাজে আসে।

৫. কিছু কিছু ওষুধ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য দায়ী (যেমন নিয়মিত আইবুপ্রোফেন জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, আয়রন বা ক্যালসিয়াম বড়ি)। এসব বিষয় খেয়াল করতে হবে। কফি, পিৎজা, ফাস্ট ফুড বা পাস্তার মতো খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। চকলেট, ভাজাপোড়া, লাল মাংস (গরু, খাসি ইত্যাদি), চিপস, প্রচুর চিনিযুক্ত বেকারি খাদ্য যেমন কেক, পেস্ট্রি কেক এবং আয়রন ক্যাপসুল, কাঁচাকলা ইত্যাদি কম খাওয়াই ভালো।

৬. এতেও উপকার না পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন বা ব্যবহার করা যায়। তবে এগুলো বেশি পরিমাণে বা নিয়মিত সেবন করা অনুচিত। কারণ, এতে মলদ্বারের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা

আগেই বলা হয়েছে কোষ্ঠকাঠিন্য মোটেও রোগ নয় বরং রোগের লক্ষণ মাত্র। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীকে প্রথমে হজমের সমস্যা নির্মূল করতে হবে।

১) প্রতিদিন সকালে আমলকী-হরীতকী-বহেড়া এই ত্রিফলা চূর্ণ জলে মিশিয়েও পান করা যায়।

২) ছোটদের কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) থাকলে গোটাকয়েক খেজুর জলে চটকে বীজকে বাদ দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ান প্রতিদিন সকালে। কয়েকদিনের মধ্যেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর হয়ে গেলে তাকে শাকসব্জি দেওয়া খাদ্য খাওয়ান। বাচ্চাকে খেজুর খাওয়ালে পুষ্টিও হয় আবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূরে থাকে।

৩) এছাড়াও চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে, প্রতিদিন সকালে খালিপেটে এক গ্লাস গরম জল পান, আবার তিন চামচ রেডির তেল ঈষদুষ্ণ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে কয়েকদিন খেলেও সমস্যা দূর হয়।

৪) হরিতকী, আমলকি, বহেড়া, আদাশুঁট, পিপুল, জোয়ান, যবক্ষার, সোনাপাতা ও বিট লবণের ৫০ গ্রাম করে নিয়ে রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে একটি পাত্রে রেখে দিন। প্রত্যেকদিন দুবেলা ভাত খাবার পর ১ চামচ করে খেয়ে জল খান। যদি কোষ্ঠকাঠিন্য বেশি থাকে তবে রাতে দু'চামচ এই মিশ্রণের গুঁড়ো জলে মিশিয়ে খান।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, অপরিকল্পিত ডায়েটের কারণে হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই সমস্যা বংশানুক্রমিক। কোষ্ঠকাঠিন্যে সময়মতো যথাযথ চিকিত্সার ব্যবস্থা বা সতর্কতা অবলম্বন না-করলে তা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া উচিত। প্রথমিক পর্যায়ে অ্যালোপ্যাথি ওষুধপত্রের চেয়ে প্রকৃতিক উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) নিরাময় করা সম্ভব। জেনে নিন ৪টি ঘরোয়া উপায় যা কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় করতে অব্যর্থ।

কোষ্ঠকাঠিন্যের কয়েকটি অব্যর্থ ঘরোয়া চিকিৎসা

১) প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ১ ঘণ্টা আগে একটি খোসাসমেত একটা গোটা আপেল খান। উপকার পাবেন।

২) রাতে ঘুমাতে যাবার আগে এক কাপ উষ্ণ জল খান। উষ্ণ জল খেলে তা হজমে সহায়তা করবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করবে। তাই নিয়মিত রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক কাপ উষ্ণ জল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৩) একটি বড় এলাচ এক কাপ গরম দুধে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই এলাচটি থেঁতো করে দুধের সঙ্গেই খেয়ে ফেলুন। মারাত্মক রকমের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় সকালে আর রাতে এই ভাবে এলাচ-দুধ খেতে পারলে দ্রুত উপকার পাবেন।

৪) রাতের শোবার আগে এক গ্লাস উষ্ণ জলে এক চামচ মধু আর এক চামচ পাতি লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন খেয়ে দেখুন। চেষ্টা করুন বাঁ দিকে পাশ ফিরে ঘুমোতে। এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় দ্রুত উপকার পাবেন।

কোষ্ঠকাঠিন্যের (Constipation) সুষম খাদ্য

কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) হলেই আমরা ভাবতে শুরু করি খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। কি খাব, কি খাবনা, কিভাবে খাবো এরকম বহু প্রশ্ন আসতে থাকে মনের মধ্যে। কিন্তু যেরকমটা বলা হয়েছে যে কোষ্ঠকাঠিন্য কোনো রোগ নয় তাই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সেরকম কোনো বাধা-নিষেধ নেই। শুধুমাএ ‌একথা মাথায় রাখতে হবে খাবার যেন বাড়ির হয় এবং পুষ্টিকর।

প্রতিদিন পাতে শুধুই মাটন বা চিকেন খেলে চলবে না, সঙ্গে সব্জি রাখতেই হবে। তাই করোলা সেদ্ধ, বিভিন্ন ধরনের সব্জি মেশানো তরকারি খান। সব্জির মধ্যে থাক পেঁপে, গাজর, ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি, ওল, ঢ্যাঁড়স, পটল, বরবটি, শিম, বিনস, ব্রকোলি, লাউ, মুলো, পাতাযুক্ত শাক (বেতো শাক, পালং শাক ইত্যাদি)। পদের মধ্যে আপেল, পাকা কলা ইত্যাদি।

শাস্ত্রে আছে শাকে বৃদ্ধি মল। তাই শাক বেশি করে খাবেন। ঘি, তেলেভাজা খাবেন না, পুষ্টিকর ও লঘুপাচ্য খাবার খাবেন।

Kolkata Corner

Post a Comment

0 Comments