শিবলিঙ্গের তত্ত্বকথা
ভারতের অধিকাংশ দেব-দেবী সর্বত্র পূজিত হন মূর্তি রূপে কিন্তু ভগবান শিবের পূজা লিঙ্গ রূপে করা হয় কেন? পৌরাণিক তত্ত্বের একটি বড়ো প্রশ্ন যা মানুষের জানা প্রয়োজন
শিবলিঙ্গের তত্ত্বকথা
প্রাচীন যুগ হতে আবহমানকাল ধরে আমরা ভগবান শিবের লিঙ্গ পূজা করে আসছি। "হিন্দুপুরাণ" মতে শিবলিঙ্গ হল ভগবান শঙ্করের লিঙ্গ, অর্থাৎ শিবলিঙ্গ হল একটি পুরুষ লিঙ্গ। এবং এই লিঙ্গটি যার উপর অবস্থিত তাকে যোনি বলা হয় অর্থাৎ এটি একটি স্ত্রীলিঙ্গ। শিবের লিঙ্গটি একটি যোনির মধ্যে অবস্থান করে। প্রতিটি শিবলিঙ্গ হল ভগবান শিব ও শক্তির মিলিত স্বরূপ। প্রতিটি শিবলিঙ্গের দুটি খন্ড থাকে একটি হল পুরুষ লিঙ্গ বা পুরুষ জননেন্দ্রিয় এবং অপরটি হল স্ত্রীলিঙ্গ বা স্ত্রী জননেন্দ্রিয়। বহুকাল পূর্বে সৃষ্টির রচনার পর সপ্তঋষি সহ আরো অনেক ঋষিগণ সম্মিলিত হয়ে একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন, এবং যোগ্য সম্পন্ন হওয়ার পর যজ্ঞের সুফল বা শক্তি নির্গত হয়। কিন্তু ঋষিদের মধ্যে কেউই জানতেন না এই যোগ্যের মহাফল বা মহাশক্তি কার পাওয়া উচিত বা কে এই মহাশক্তির যোগ্য। সেই সময় দেবঋষি নারদের আগমন হয়। তার মতে এই ফলের যোগ্য অধিকারী হলেন ত্রিদেব অর্থাৎ ভগবান "ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ্বর"। কিন্তু তিনি এও বলেন যে তিনিও জানেন না যে ত্রিদেবের মধ্যে কোন একজন এর যোগ্য অধিকারী, তাই তিনি ঋষিগণকে ত্রিদেবের পরীক্ষা নেওয়ার উপদেশ দেন। তখন সকল ঋষিগণ মিলে সপ্তঋষির অন্যতম ঋষি মহর্ষি ভৃগুকে নির্বাচিত করেন এই কাজটি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য মতো, মহর্ষি ভৃগু সত্যলোকে উপস্থিত হন শ্রীব্রহ্ম পরীক্ষা করিবার তরে, কিন্তু তিনি দেখেন যে ব্রহ্মদেব এবং দেবী সরস্বতী সংগীতচর্চায় নিমগ্ন রয়েছেন। মহর্ষি ভৃগুর আগমন ব্রহ্মদেব এবং দেবী সরস্বতী কেউই লক্ষ্য করেননি, এই দেখে মহর্ষি ভৃগু খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং ব্রহ্মকে অভিশাপ দেন, হে ব্রহ্মা তুমি আমার আগমন উপেক্ষা করে, আমাকে লক্ষ্য না করে আমাকে অপমানিত করেছো তাই পুষ্কর সারা বিশ্বসংসারে আর কোথাও তোমার পুজো হবে না। অনুরূপভাবে যখন ঋষিদেব ভগবান শঙ্করের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কৈলাসে উপস্থিত হন তখন তিনি দেখেন ভগবান শংকর বিবাহ তথা সংসার আশ্শাদে ব্যস্ত, এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বাক্যালাপে বিভোর। কিন্তু যখন ভগবান শংকর মহর্ষি ভৃগুকে লক্ষ্য করেন তিনি রেগে গিয়ে বলে উঠেন যে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সময়ে আপনি কি করে বিনা অনুমতিতে এই জায়গায় উপস্থিত হন। এই শুনে মহর্ষি ভৃগু খুবই ক্ষুব্ধ হন ভগবান সকলের প্রতি, এবং ভগবান শংকরকেও অভিশাপ দেন যে, বিশ্বসংসারের তুমি লিঙ্গ রূপে পূজিত হবে। এবং সেই থেকেই জগত সংসারে ভগবান শিব লিঙ্গ রূপে পূজিত হন।
শিবলিঙ্গের তত্ত্বকথা
কিন্তু পুরান মতে কথিত আছে মূর্তি হল সাকারের প্রতীক এবং লিঙ্গ হল নিরাকারের প্রতীক। এই লিঙ্গ মানবদেহের কোন নির্দিষ্ট অঙ্গকে বোঝায় না। এই লিঙ্গ সাক্ষাৎ ব্রহ্মের প্রতীক। ব্রহ্মভাব যুক্ত শিবের নিরাকার রুপই হলো শিবলিঙ্গ। এই শিবলিঙ্গে আড়াআড়িভাবে তিনটি সাদা রেখা ও চোখের নিদর্শন পাওয়া যায়, এর থেকে আমরা বুঝতে পারি এটি কোন মানবদেহের অঙ্গ নয় বরং এটি একটি ভাবের অবস্থান মাত্র। শিবলিঙ্গ হল একটি কল্যাণকারী প্রতীক বা চিহ্ন। একদা ব্রহ্মা ও বিষ্ণু ভগবানের মধ্যে জীবজগতের সৃষ্টি ও লালন-পালন নিয়ে এক বিশাল বিবাদ শুরু হয়। সেই বিবাদ নিরসন করার জন্য দেবতাগণ ভগবান শিবের দ্বারস্থ হন। দেবতাগণের দ্বারা প্রেরিত হয় ভগবান শিব শ্রীব্রহ্মা ও শ্রীবিষ্ণুর নিকট প্রকট হন। ভগবান ব্রহ্মা ও বিষ্ণু হাত জোড়ো অবস্থায় ভগবান শিবের দুদিকে দাঁড়িয়ে থাকেন। ব্রহ্মজ্ঞানী শিব দুজনের কাছে পুরুষ বস্তু (আবহমানকাল ধরে যে বস্তু অবিকৃত এবং সুস্থির অবস্থায় রয়েছে) এবং প্রাকৃত বস্তুর তত্ত্ব বর্ণনা করেন। ভগবান শিবের কথা শুনতে শুনতে শ্রীব্রহ্মা ও শ্রীবিষ্ণু শিবের নিরাকার রূপের অথবা ব্রহ্মভাবের পুজো করেন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু ব্রহ্মভাব স্বরূপ শিবের লিঙ্গকে পূজা করেছিলেন বলে আজও জগত সংসারে ভগবান শিবের লিঙ্গকেই পুজো করা হয়। তাছাড়াও ভগবান শিবের লিঙ্গ হল পিতা-মাতার স্বরূপ যা থেকে জীবের সৃষ্টি হয়।
সাদা শিবলিঙ্গ বাড়িতে রাখতে নেই কেন
শাস্ত্র অনুযায়ী বাড়িতে সাদা শিব লিঙ্গ রাখতে কোনো বাধা নেই, এবং এর পূজাও করা যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন গৃহস্ত ঘরে সাদা শিবলিঙ্গ তার উদ্দেশ্য ও গুরুত্বের সঙ্গে পারস্পরিক বিপরীত ক্রিয়া করে। কারণ আমরা যেমনটা জানি, সাদা রঙ হল বৈরাগ্যের প্রতীক, অমরত্বের রঙ এবং আধ্যাত্মিকতা যুগের চরম সীমার রঙ। এই রঙ অর্থাৎ সাদা শিবলিঙ্গ যখন আমরা বাড়িতে প্রতিস্থাপন করি বা মনে মনে কল্পনা করি তখন আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে থাকি না। আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে চাই। এই কারণেই সাধু-সন্ন্যাসীরা ধ্যান করার ক্ষেত্রে এই রঙ ব্যবহার করে থাকেন। এই রঙের শিবলিঙ্গ মন্দির অবশ্যই পূজা করা যেতে পারে। এক কথায় বলা যেতে পারে, সংসারের মধ্যে থেকে যদি আধ্যাত্মবাদ ও বৈরাগ্যকে যদি এত পরিমান গুরুত্ব দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে কোথাও একটা সাংসারিক তরঙ্গে ব্যাঘাত ঘটে। সাধারনত আমরা দেখে থাকি বাড়ির মা, ঠাকুমা, পিসিমা অর্থাৎ বাড়ির মহিলারা শিবের পুজো করে থাকেন, কিন্তু এক্ষেত্রে মহিলাদের সাদা শিবলিঙ্গের পূজা না করাই ভালো।
তাই শাস্ত্র মতে বলা হয়েছে, গৃহের একদম ভিতরে অর্থাৎ অভ্যন্তরের শিবলিঙ্গের পূজা না করে গৃহের বাইরে বা গৃহ সংলগ্ন কোনো ভালো জায়গা বা মন্দিরে রাখা যেতে পারে। এবং পুরোহিত দিয়ে নিত্যই ওই শিবলিঙ্গের পূজা করা যেতে পারে।
আমরা অনেকেই বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, মেলা, অনুষ্ঠান থেকে শিবলিঙ্গ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিমা বা মূর্তি এনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কিছু সুফলের বদলে সাংসারিক, নিজস্ব জীবনে কিছু খারাপ প্রভাব পড়ে। তাই যেকোনো জিনিসের রং, আকার এবং তাদের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বুঝে বাড়িতে প্রতিস্থাপন করা উচিত। তাতে আমরা অনেকটাই সুফল লাভ করতে পারি। মোদ্দা কথা ভক্তি মন থেকেই করা যায় সে ক্ষেত্রে কোন মূর্তি বা প্রতিমার প্রয়োজন হয় না, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলাটাই বড় কথা।
শিবের মাথায় জল ঢালা হয় কেন
শিব অর্থাৎ সত্য ন্যায়ের পথ বা এই পথে চলা। ভগবান শিব খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট হন। এখানে অল্প বলতে শুধুমাত্র সামান্য জল এবং বেলপাতাকেই বোঝানো হয়েছে। এই সামান্য দুটি প্রাকৃতিক উপাদানে দেবাদিদেব মহাদেব সন্তুষ্ট হন।
কিন্তু আমাদের জানতে হবে শিবের মাথায় জল ঢালা হয় কেন? এ সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের পুরাণে ফিরে যেতে হবে। যখন সমস্ত ভগবান অসূরদের মধ্যে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল তখন সেই মন্থন থেকে বিভিন্ন বস্তু নির্গত হয়েছিল। মন্থনের একসময় 'হলাহল' নামক এক বিষাক্ত গরল নির্গত হয়। কিন্তু ও অসূর ও ভগবানদের মধ্যে কোন পক্ষই এই বিষাক্ত গরল গ্রহণ করতে চায় না। সেই সময় আবির্ভাব হয় ভগবান শিবের, তিনি সেই বিষাক্ত গরল পান করেন। এই গরল পান করার পর তার কন্ঠ অর্থাৎ গলা নীল বর্ণের হয়ে যায় ( এই থেকেই দেবাদিদেব মহাদেব নীলকন্ঠ নামেও পরিচিত)। সমস্ত ভগবান কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান। ভগবান শিব গরলের জালায় কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েন। সেই সময় ভগবানগণ তার মাথায় জলের অভিষেক করেন। তাতেও তার গলায় গরলের নীলাভাব দূর হচ্ছিল না। তাই সমস্ত ভগবান মিলে ভগবান শিবকে বেলপাতা খাওয়াতে থাকেন। কিছুসময়ের মধ্যেই দেবাদিদেব মহাদেব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। এবং এই থেকে শিবের মাথায় জল ঢালার প্রচলন শুরু হয়
শিবলিঙ্গের ইতিহাস
শিবলিঙ্গের ইতিহাস
শিবলিঙ্গের বাস্তবিক অর্থ
শিবলিঙ্গ
ভগবান শিবের গলায় সাপ থাকে কেন
ভগবান শিবের মাথায় চাঁদ থাকে কেন
FAQ
1. মক্কায় শিব বন্দি কেন?
2. শিবের জটা কে কি বলে?
3. শিব কার ধ্যান করেন?
4.শিবের অবতার কি কি?
5. শিবের গলায় সাপের নাম কি?
6. শিবলিঙ্গের মুখ কোন দিকে থাকে?
7. শিবরাত্রির সলতে বাগধারাটির অর্থ কি?
8. শিব রাতে মেয়েরা কি করে?
9. শিব শব্দের অর্থ কি?
10. শিব কে?
11. শিব চতুর্দশী কেন পালন করা হয়?
- শিবরাত্রির দিনে শিব পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন।
- প্রত্যেক বছর ফাল্গুনমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে শিবরাত্রি উদযাপন করা হয়।
- বিশ্বাস করা হয়, শিবরাত্রির রাতই মহাদেবের প্রিয় রাত।
- শিবরাত্রির দিনেই মহাদেব তাণ্ডব নৃত্য করেছিলেন। আর তারপর থেকেই এই নৃত্য পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যায়।
- অবিবাহিত মেয়েদের জন্য এটাই সবচেয়ে পূণ্যের রাত। যাঁরা ভগবান শিবের মতো স্বামী চান, তাঁরা এই দিন ব্রত করেন।
- শিবরাত্রির দিনের এই ব্রত শুধু অবিবাহিত মেয়েরাই নন, বিবাহিত মেয়েরা এমনকি ছেলেরাও এই ব্রত করতে পারেন।
- শুধু মহাদেবের মতো স্বামী চেয়ে বরই নয়, সাফল্য এবং সমৃদ্ধি চেয়েও এই ব্রত করা যায়।
- শিবরাত্রির ব্রত করলে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- নিশীথ কলা বা যে সময়ে মহাদেব শিব লিঙ্গের রূপ ধারণ করেছিলেন, সেই সময়ই শিবরাত্রি ব্রত উদযাপনের উপযুক্ত সময়।
- সমুদ্র মন্থনে বিষ পাণ করেছিলেন মহাদেব। বিশ্বাস করা হয়, এই কারণেই সারারাত জেগে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়।
- শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিবরাত্রি পালন করা হয়।
- পূরাণে উল্লেখ করা রয়েছে যে ঠিক কোন কোন উপাদান ব্যবহার করা হয় শিবরাত্রিতে।
- শিবরাত্রিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলির প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা উপকারীতা রয়েছে।
- মহাশিবরাত্রির ব্রত করলে রজঃ গুণ এবং তমোঃ গুণগুলির সংযম শক্তি বাড়ে।
- মহাদেবের ভক্তরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শিব মন্ত্র 'ওম নমঃ শিবায়' স্তব করে থাকেন।
0 Comments